সূচিপত্র
নবম
অধ্যায়:
যুক্তপ্রদেশে
বিপ্লবী
কর্মকাণ্ড।
১২০. বেনারস
ষড়যন্ত্রের
আগে
যুক্তপ্রদেশ
দশম
অধ্যায়:
যুক্তপ্রদেশ
এবং
বিপ্লবী
আন্দোলনের
মধ্যে
সংযোগ।
নবম
অধ্যায়:
যুক্তপ্রদেশে
বিপ্লবী
কর্মকাণ্ড।
১২০. বেনারস ষড়যন্ত্রের আগে যুক্তপ্রদেশ
আগ্রা ও আউধের যুক্তপ্রদেশ ভৌগোলিকভাবে বিহার ও উড়িষ্যা দ্বারা বাংলা থেকে পৃথক এবং উত্তর ভারতের প্রাণকেন্দ্র। এই প্রদেশের উল্লেখযোগ্য দুটি শহর হল বেনারস এবং এলাহাবাদ শহর, যা সমস্ত হিন্দুদের দৃষ্টিতে পবিত্র। এই প্রদেশের আরো দুটি উল্লেখযোগ্য শহর হল আগ্রা (যা একসময় সাবেক মুঘল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল ছিল) এবং লক্ষ্ণৌ, যারা পূর্বে একটি মুসলিম রাজ্যের রাজধানী ছিল। এ দুটি শহর ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র ছিল।
বর্তমানে এই প্রদেশগুলোর অবস্থা শান্তিপূর্ণ। এই প্রদেশে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং নিরন্তর ধাক্কা আসে ১৯০৭ সালের নভেম্বর মাসে, এলাহাবাদে ‘স্বরাজ্য’ নামে একটি সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। যুক্তপ্রদেশের বাসিন্দা শান্তি নারায়ণ, যিনি পূর্বে পাঞ্জাবের একটি সংবাদপত্রের উপ-সম্পাদক ছিলেন, তিনি লাজপুত রায় এবং অজিত সিং-এর (পাঞ্জাবের দুই নির্বাসিত বিপ্লবী) মুক্তিকে (দেখুন অনুচ্ছেদ ১২৮) স্মরণ করতে চেয়েছিলেন নতুন পত্রিকায়। এই পত্রিকার লেখার ধাঁচ শুরু থেকেই সরকারের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ ছিল এবং ধীরে ধীরে তা তীব্রতর হয়ে ওঠে। অবশেষে, শান্তি নারায়ণকে মুজাফ্ফরপুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে আপত্তিজনক নিবন্ধ প্রকাশের দায়ে দীর্ঘ মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। তবে, ‘স্বরাজ্য’ সংবাদপত্র পরপর আটজন সম্পাদকের অধীনে এগিয়ে যায়, যাদের মধ্যে তিনজনকে আপত্তিজনক লেখালেখির দায়ে বিচারের সম্মুখীন করা হয় এবং দীর্ঘ মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। এই আট জন সম্পাদকের মধ্যে সাতজনই ছিলেন পাঞ্জাবের। ১৯১০ সালের নতুন ‘ইন্ডিয়ান প্রেস অ্যাক্ট’ কার্যকর হওয়ার পরেই কেবল এই পত্রিকাটি বন্ধ করা হয়েছিল। এর আপত্তিজনক নিবন্ধগুলির মধ্যে একটি ছিল মুজাফ্ফরপুরের খুনি ক্ষুদিরাম বসুকে উদ্দেশ্য করে লেখা একটি মানপত্র। পত্রিকার অন্যান্য নিবন্ধের মধ্যে “বোমা বা বয়কট”, “অত্যাচারী এবং নিপীড়ক” ইত্যাদির মতো আপত্তিজনক বিষয়বস্তু নিয়ে লেখালেখি ছিল। পত্রিকাটি যে অধ্যবসায়ের সাথে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে তা সত্ত্বেও, এটি যুক্তপ্রদেশে দৃশ্যমান কোনো প্রভাব ফেলেনি। ১৯০৯ সালের শেষের দিকে ‘কর্মযোগীন’ নামে একই ভাবধারার আরেকটি পত্রিকা, সেটিও এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত হয়, যা ১৯১০ সালে বন্ধ করা হয়, সমানভাবে অকার্যকর ছিল।
১৯০৮ সালে হোতি লাল ভার্মা নামে একজন জাঠ – যিনি পাঞ্জাবে সাংবাদিকতার যুক্ত ছিলেন এবং তখনকার কলকাতাভিত্তিক পত্রিকা ‘বন্দে মাতরম’-এর আলিগড় সংবাদদাতা ছিলেন (যে পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ এবং তার কয়েকজন সহযোগী) – বিপ্লবী প্রচার-প্রচারণায় বেশ পরিচিতি অর্জন করেছিলেন এবং ফলশ্রুতিতে তাকে দশ বছরের জন্য নির্বাসিত করা হয়। তিনি দূর প্রাচ্য এবং ইউরোপে ভ্রমণ করেছিলেন এবং উগ্রবাদী চিন্তাচেতনায় প্রভাবিত ছিলেন। তার কাছে বোমা তৈরির একটি ম্যানুয়ালের কিছু অংশ পাওয়া যায় যা কিনা ‘কলকাতা অনুশীলন সমিতি’ কর্তৃক সংকলিত বোমা তৈরির ম্যানুয়ালের হুবহু অনুরূপ। তিনি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্রের যুবকদের কাছে বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রচার করার মত উচ্চাভিলাষী কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু কোনো সাফল্য পাননি। তার বিচারকার্য স্থানীয় কোন আগ্রহ সৃষ্টি করেনি।
১২১. বেনারস ষড়যন্ত্র মামলা।
এখন আমরা বেনারস ষড়যন্ত্র মামলার কাহিনীতে আসি। বিখ্যাত শহর বেনারসে অনেক স্কুল এবং দুটি গুরুত্বপূর্ণ কলেজ রয়েছে। এর স্থায়ী জনসংখ্যার একটি বড় অংশ হল বাঙালি; এবং বাঙালিরা প্রায়শই স্থায়ী নিবাসের জন্য এস্থানটি নির্বাচন করেন, যেমনটি ভারতের সমস্ত অংশ থেকে হিন্দু তীর্থযাত্রীরা করেন। এটা অবশ্যম্ভাবী ছিল, বিচ্ছিন্নতাবাদের যে বিষ অন্যান্য এলাকায় বিষক্রিয়া তৈরি করেছে, তা আজ বা কাল, কোনো না কোন পরিমাণে বেনারসেও প্রবেশ করবে।
১৯০৮ সালে শচীন্দ্র নাথ সান্যাল নামে এক তরুণ বাঙালি, যিনি তখন বাঙালিটোলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছিলেন, অন্যান্য যুবকদের সাথে মিলে ‘অনুশীলন সমিতি’ নামে একটি ক্লাব শুরু করেন। তৎকালীন ‘ঢাকা অনুশীলন সমিতি’ নামে উদীয়মান একটি সমিতির অনুরকনে এই নামকরণ করা হয়। কিন্তু যখন ওই সমিতি ফৌজদারি তদন্তের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়, তখন বেনারস সমিতি “ইয়ং মেনস্ অ্যাসোসিয়েশন” নাম পরিগ্রহণ করে। এটি উল্লেখ্য যে একজন ব্যতীত এই সমিতির সকলেই ছিলেন বেনারসের বাসিন্দা, এই একজন ছিলেন ‘স্টুডেন্টস ইউনিয়ন লীগ’ নামে ভ্রাতৃপ্রতিম একটি সংগঠনের সদস্য এবং পরবর্তীকালে এই একজনই ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন। মূল সমিতির বাহ্যিক উদ্দেশ্য ছিল এর সদস্যদের নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শারীরিক উন্নতিসাধন, কিন্তু বেনারস ষড়যন্ত্র মামলার বিচারকারী কমিশনারদের ভাষায়, “এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, শচীন্দ্র এই সমিতিকে বিচ্ছিন্নতাবাদ ছড়ানোর কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। দেব নারায়ণ মুখার্জি নামে সমিতির এক প্রাক্তন সদস্য আমাদের বলেছেন, সমিতির সদস্যরা সরকারের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে নিজেদের মত প্রকাশ করতেন। আরেক সাক্ষী বিভূতির মতে, এই সমিতির একটি অভ্যন্তরীণ বলয় ছিল যারা এর আসল উদ্দেশ্যগুলোতে সম্পূর্ণরূপে দীক্ষিত ছিল। বিচ্ছিন্নতাবাদী দীক্ষা ছড়ানো হত নৈতিকশিক্ষা নামে একটি তথাকথিত পাঠচক্রে, যেখানে ভবগত গীতার এমন ব্যাখ্যা করা হত যেন এটি একরকম বিচ্ছিন্নতাবাদী কাজে এমনকি হত্যাযজ্ঞ সংঘটনের মত কাজের পক্ষেও ন্যায্যতা প্রদান করে। বার্ষিক কালীপূজায় একটি সাদা কুমড়োর বলি দান করা হতো (এটি পূজার একটি সাধারণ অনুষঙ্গ, স্বাভাবিকভাবে এই আচারের কোনো দুরভিসন্ধিমূলক তাৎপর্য নেই), যা কিনা শ্বেতাঙ্গ জাতির প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করা হত, যাদের বহিষ্কারের আকাঙ্ক্ষায় বিশেষ ধরণের অর্চনা করা হত। (দেখুন বেনারস ষড়যন্ত্র মামলার রায়)
এই ‘অনুশীলন সমিতি’ গঠনের আগে বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা বেনারস পরিদর্শন করেছিলেন বলে প্রমাণ রয়েছে; এবং এটা নিশ্চিত যে শচীন্দ্র এবং তার সহযোগীরা (তারা তখন নিছক বালক মাত্র) এবং প্রধানত প্রদেশের বাঙালিরা, এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে কারো না কারো দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিল। ক্লাবটি ১৯০৯ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল, তবে মতবিরোধ ছাড়া নয়। প্রথমত, এটি কিছু সদস্যকে হারিয়েছিল যারা তার রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ এবং সরকারের প্রতি শত্রুভাবাপন্নতা দেখে বিদ্রোহ করেছিল। তারপর এটি শচীন্দ্র সহ তার সবচেয়ে চরমপন্থি অংশকে হারায়। এই অংশটি তত্ত্বকে বাস্তবে চর্চা এবং কথাকে কর্মে পরিণত করার তাড়নায় তাড়িত ছিল। তারা চেয়েছিল বাংলার বিচ্ছিন্নতাবাদী সমিতিগুলির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে। এজন্য তারা আরেকটি নতুন দল গঠন করেছিল। পরবর্তী বিচারে সাক্ষ্য দানকারী এক সাক্ষীর মতে, শচীন্দ্র সময়ে-সময়ে কলকাতা সফর করেন এবং রাজাবাজারের সেলিব্রিটি শশাঙ্ক মোহান হাজরা ওরফে অমৃতা হাজরার সাথে পরিচিত হয়। (সাক্ষীর হাজির করা প্রমাণ সম্পর্কে জানতে দেখুন অনুচ্ছেদ ৬১। অমৃতা হাজরা রাজাবাজার মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়।) এবং তার কাছ থেকে বোমা এবং অর্থ সংগ্রহ করে। ১৯১৩ সালের শরৎকালে, তার সহযোগীরা বেনারস স্কুল ও কলেজগুলোতে বেশ কটি বিচ্ছিন্নতাবাদী লিফলেট বিতরণ করে এবং ডাকযোগে অন্যান্য লিফলেট প্রচার করে। বিভূতি নামে এক সাক্ষীর মতে, তারা প্রদেশে ঘুরে বেড়াতেন এবং গ্রামের মানুষের মাঝে বক্তৃতা দিতেন। এই সাক্ষী আরো বলেন, “বক্তৃতার বিষয়বস্তু হত আমাদের অবস্থার উন্নতিকল্পে ইউরোপীয়দের বের করে দেয়া নিয়ে। আমরা প্রকাশ্যেই ইউরোপীয়দের বের করে দেয়ার কথা প্রচার করতাম এবং এর মাধ্যমে আমাদের অবস্থা উন্নতি হবে, এমন প্রচারণা চালাতাম।”
১৯১৪ সালের গোড়ার দিকে দিল্লি ও লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত কুখ্যাত রাসবিহারী বসু বেনারসে আসেন এবং কার্যত আন্দোলনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যদিও তার গ্রেপ্তারের জন্য পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছিল এবং তার ছবি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল, তারপরও তিনি ১৯১৪ সালের অধিকাংশ সময় জুড়ে বেনারসে বসবাস করতে সক্ষম হন, দৃশ্যত পুলিশের অজান্তেই। বেনারস শহরটি নানানজাতির মানুষের শহর, এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ ভিন্নভিন্ন এলাকায় জনাকীর্ণ অলিগলিতে ঘুপচির মত স্থানে বসবাস করে। বাঙালিটোলা, বাঙ্গালিদের বিশেষ এলাকা, অনেকাংশে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সুতরাং, উত্তরপ্রদেশের পুলিশ, যারা বাংলা বলতে পারে না, তাদের পক্ষে এই এলাকায় কি হয়, কে আসে-যায়, এসব খোঁজ রাখা দুষ্কর। রাসবিহারী বাঙালিটোলার কাছাকাছি থাকতেন এবং ঘরের বাইরে ব্যায়াম করতে হলে সাধারণত রাতে করতেন। শচীন্দ্র গ্যাংয়ের বিভিন্ন সদস্য তার সাথে দেখা করতে আসতো এবং তিনি একবার তাদেরকে বোমা এবং রিভলবার ব্যবহারের একটি ডেমো দেখিয়েছিলেন। ১৯১৪ সালের ১৮ নভেম্বর রাতে তিনি যখন দুটি বোমার ক্যাপ পরীক্ষা করছিলেন, তখন বোমা দুটো বিস্ফোরিত হয়ে তাকে এবং শচীন্দ্র উভয়কেই আহত করেছিল। এরপর তিনি বাঙালিটোলার একটি বাড়িতে তার নিবাস স্থানান্তর করেন। সেখানে বিষ্ণু গণেশ পিঙ্গলি নামে এক তরুণ মারাঠা তার সাথে দেখা করেন, যিনি বোম্বাইয়ের পুনা জেলার বাসিন্দা ছিলেন। পিঙ্গলি আমেরিকায় ছিলেন এবং ১৯১৪ সালের নভেম্বরে ঘাদির পার্টির কিছু শিখের সাথে ভারতে ফিরে এসেছিলেন। (দেখুন অনুচ্ছেদ ১৩২-১৩৮) তিনি বলেন যে, বিদ্রোহের উদ্দেশ্যে আমেরিকা থেকে চার হাজার লোক এসেছে এবং সেখানে আরও বিশ হাজার লোক আছে যারা বিদ্রোহ শুরু হলে আসবে। তিনি আরো বলেন যে কলকাতায় পনের হাজার লোক আছে যারা বিদ্রোহ শুরু হলে আসবে। রাসবিহারী শচীন্দ্রকে পাঞ্জাবে পাঠিয়েছিলেন সেখানে কি ধরণের কর্মকাণ্ড করা সম্ভব তা যাচাই জন্য। শচীন্দ্র তার মিশন সম্পন্ন করেন। সেখানকার ঘাদির পার্টির সদস্যরা বোমা তৈরির ম্যানুয়ালের সন্ধানে ছিল। তিনি সেখানকার ঘাদির বিপ্লবীদের কয়েকজনকে অবহিত করেন যে, এই ম্যানুয়ালটি সহজেই পাওয়া যায় এবং তাদের কর্মকাণ্ডে বাঙালিদের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন।
১৯১৫ সালের জানুয়ারিতে পিঙ্গলির সাথে শচীন্দ্র বেনারসে ফিরে আসেন এবং তাদের আগমনের পরে, রাসবিহারী তার বাসায় (যে কিনা সেসময় আবার তার ঠিকানা পরিবর্তন করেছিল), তাদের উপস্থিতিতে দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা আয়োজন করেন। সেখানে তিনি ঘোষণা করেন যে, একটি সাধারণ বিদ্রোহ আসন্ন, এবং তার শ্রোতাদের অবহিত করেন যে তাদেরকে অবশ্যই স্বদেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। দামোদর সরূপ নামে এক স্কুল শিক্ষকের এলাহাবাদে বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দেয়ার কথা ছিল। রাসবিহারী নিজেই শচীন্দ্র ও পিঙ্গলিকে সাথে নিয়ে লাহোরে যান। বাংলা থেকে বোমা ও অস্ত্র আনার দায়িত্ব দেয়া হয় দু'জনকে, এবং অন্য আরো দু'জনকে (যাদের মধ্যে একজন বিনায়ক রাও কপিলে নামে একজন মারাঠা ছিল যে পরে লক্ষ্ণৌতে খুন হয়) পাঞ্জাবে বোমা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। বিভূতি এবং প্রিয়ানাথ নামে আরও দু'জনের দায়িত্ব ছিল বেনারসে সৈন্যদের প্রলুব্ধ করার এবং নলিনী নামে এক বাঙালির দায়িত্ব ছিল মধ্যপ্রদেশের জবলপুরে একই কাজ করার। এই পরিকল্পনাগুলি কার্যকর করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল; রাসবিহারী এবং শচীন্দ্র, লাহোর এবং দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হন, তবে শচীন্দ্র সরাসরি বেনারস ফিরে আসে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের কমান্ড গ্রহণ করার জন্য। ১৪ই ফেব্রুয়ারি মণি লাল (পরবর্তীতে মামলার সাক্ষী) এবং বিনায়ক রাও কপিলে (যারা দুজনই পশ্চিম ভারতের বাসিন্দা) আঠারোটি বোমার উপাদান ভর্তি একটি পার্সেল নিয়ে বেনারস থেকে লাহোরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। যেহেতু ট্রেনে ভিড় ছিল, তাই দুর্ঘটনাজনিত আঘাত থেকে পার্সেলটিকে রক্ষা করার জন্য, তারা মাঝে লক্ষ্ণৌ হয়ে যায় এবং লক্ষ্ণৌ ও মুরাদাবাদ উভয় জায়গায় অতিরিক্ত ভাড়া প্রদান করে। তারা মূলত তৃতীয় শ্রেণির ভাড়া নিয়েছিল। লাহোরে পৌঁছানোর পর রাসবিহারী মনি লালকে জানান যে একযোগে সশস্ত্র বিদ্রোহের তারিখ হবে এ মাসের (অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসের) ২১ তারিখ। এই তারিখটি বেনারসে জানানো হয়েছিল; কিন্তু পরে এটি পরিবর্তন করা হয়ে কারণ লাহোরের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সন্দিগ্ধ ছিল যে তাদের মধ্যে কোন একজন পুলিশের কাছে পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দিয়েছে। এই অনুমানের পিছনে তাদের যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য কারণ ছিল। তবে ষড়যন্ত্রকারীদের যেই দলটি শচীন্দ্রের অধীনে বেনারসে ছিল, তারা পরিকল্পনার এই পরিবর্তন সম্পর্কে জানত না। তারা (ফেব্রুয়ারির) ২১ তারিখ সন্ধ্যায় প্যারেড গ্রাউন্ডে গনবিদ্রোহের আশায় অপেক্ষা করতে থাকে। এরই মধ্যে, লাহোরের বিভিন্ন ঘটনাচক্রে নাশকতার ষড়যন্ত্রটি উন্মোচিত হয়ে যায় এবং প্রচুর ধরপাকড় করা হয়। রাসবিহারী এবং পিঙ্গলি বেনারসে ফিরে আসেন, কিন্তু মাত্র কয়েকদিনের জন্য। পরে তিনি তার সাথে মীরাঠে বোমা নিয়ে যান, যেখানে ২৩শে মার্চ তাকে দ্বাদশ ভারতীয় অশ্বারোহী বাহিনী একটি বাক্সে দশটি বোমাসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে, এতে এত পরিমাণ বিস্ফোরক ছিল যে তা (কোর্টের ভাষায়) “আধা রেজিমেন্ট ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট”। তাকে পরবর্তিতে লাহোর ষড়যন্ত্রে অংশ নেয়ার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তার কাছ থেকে যে বোমাগুলি পাওয়া গিয়েছিল, সাক্ষী বিভূতির ভাষ্যমতে, তা কলকাতা থেকে বেনারসে নিয়ে আসা হয় এবং বেনারসেই রাখা ছিল। বোমাগুলো যখন যখন পিঙ্গলির সাথে পাওয়া যায় তখন তা একটি টিনের ট্রাঙ্কে রাখা ছিল। পাঁচটি বোমার ক্যাপ আটকানো ছিল, এবং এই মধ্যে গানকটন সহ আরো দুটি পৃথক বোমার ক্যাপ ছিল।
রাসবিহারী কলকাতায় তার বেনারসী কয়েকজন শিষ্যের সাথে চূড়ান্ত সাক্ষাত্কারের পরে দেশ ত্যাগ করেছিলেন, যাওয়ার সময় তিনি তাদের জানিয়েছিলেন যে তিনি ‘সন্ন্যাসব্রত’ পালনে যাচ্ছেন এবং দুই বছরের মধ্যে আর ফিরবেন না। তবে তার অনুপস্থিতিতে পূর্ববাংলার শচীন্দ্র এবং নগেন্দ্রনাথ দত্ত ওরফে গিরিজা বাবুর নেতৃত্বে বিচ্ছিন্নতাবাদী লেখালেখি সংগঠন ও বিতরণ অব্যাহত রাখতে হবে। গিরিজা বাবু পূর্ববাংলা নিবাসী একব্যক্তি যিনি ‘ঢাকা অনুশীলন সমিতি’র একজন প্রবীণ সহযোগী, যার নাম সিঙ্গাপুরে গ্রেপ্তার হওয়া বাঙালি অবনী মুখার্জির (সরকার উৎখাতের উদ্দেশ্যে বাঙালি-জার্মান অস্ত্র চোরাচালান ষড়যন্ত্রের অন্যতম কুশীলব) একটি নোটবইয়ে রয়েছে। (দেখুন অনুচ্ছেদ ১১১)। শচীন্দ্র, গিরিজা বাবু এবং এই চক্রের অন্যান্য সদস্যদের পরবর্তীকালে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং ‘ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্টের’ অধীনে গঠিত একটি আদালতে বিচার করা হয়েছিল। বেশ কয়েকজন সাক্ষী হয়েছিলেন; দশজনকে দীর্ঘ মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল এবং শচীন্দ্র নাথ সান্যালকে যাবজ্জীবন নির্বাসিত করা হয়। বিচারে প্রদত্ত বিভিন্ন প্রমাণাদি শচীন্দ্রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। যেমন: সৈন্যদেরকে উগ্রবাদে জড়িত করার বিভিন্ন চেষ্টা, বিচ্ছিন্নতাবাদী লিফলেট বিতরণ, এর পাশাপাশি উপরে বর্ণিত ঘটনাগুলোর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়।
বিভূতি (তাদের চর হিসেবে কাজ করত) পুলিশি তদন্তের সময় জানান যে, তিনি এবং তার সহযোগীরা চন্দ্রনগরে সুরেশ বাবুর বাড়িতে থেকেছিলেন। এই বাড়িতে তৎক্ষণাৎ অভিযান চালানো হয়; এসময় মোটামুটি একটি অস্ত্রাগ্রারের খোঁজ পাওয়া যায়। ৪৫০টি ছয় চেম্বারের রিভলবার, এতে ব্যবহারের জন্য এক টিন কার্তুজ, একটি ব্রিচ-লোডিং রাইফেল, একটি দোনলা ৫০০-এক্সপ্রেস রাইফেল, একটি ডাবল ব্যারেল বন্দুক, সতেরোটি ছুরি, বেশ কয়েকটি কার্তুজ, এক প্যাকেট বারুদ, বেশ ক'টি ‘স্বাধীন ভারত’ ও লিবার্টি লিফলেট উদ্ধার করা হয়। বাড়িটি আগে সন্দেহের মুখে পড়েনি। শচীন্দ্র নাথ সান্যালের কাছ থেকে পুরাতন যুগান্তরের কপি এবং রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত খুনিদের ছবি পাওয়া যায়। গ্রেফতারের ঠিক মুহূর্তে তিনি ডাকযোগে প্রচারের জন্য দেশদ্রোহী লিফলেট তৈরি করছিলেন; এবং পাটনার অভিযুক্ত বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়িতে শচীন্দ্রের দাগানো এবং মলাটে শচীন্দ্রের নাম লেখা “লাইফ অফ্ মাজ্জিনি” (ইতালীয় বিপ্লবী) পাওয়া যায়।
(বেনারস ষড়যন্ত্র মামলার রায় থেকে) “বইয়ে বিভিন্ন বাক্যের নিচে আন্ডারলাইন করা ছিল, মার্জিনে বিভিন্ন টীকাটিপ্পনী লিখিত ছিল। ৩৪ পৃষ্ঠায় তেমনই একটি আন্ডারলাইন করা বাক্য দেখুন, ‘এর (অর্থাৎ এই বইয়ের) লেখাগুলি, যা দেশের প্রতিটি কোণে গোপনে প্রচার করা হয়েছিল, অনেক চিন্তাশীল তরুণকে স্থিরচিত্ত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে সাহায্য করে যা পরবর্তীতে ফল বয়ে আনে।’ এই আন্ডারলাইন করা বাক্যগুলোর টীকা হিসেবে মার্জিনে পেন্সিল দিয়ে লেখা ছিল, ‘লেখনীর মাধ্যমে শিক্ষা।’ এরকম আরেকটি আন্ডারলাইন করা বাক্য, ‘জেনোয়ায় তার সহ-ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্যে জাকোপো রাফিনি বলেন, ‘এখানে আমরা খুবই অল্পবয়স্ক পাঁচজন তরুণ আছি, সীমিত উপায়-উপকরণ সাথে নিয়ে। কিন্তু আমরা এখানে একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উৎখাত করার মত বিরাট আহ্বানে সাড়া দিয়ে জমায়েত হয়েছি।’”
বেনারস ষড়যন্ত্রে দোষীদের মধ্যে কেবলমাত্র একজন জাতিগতভাবে যুক্তপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এদের অধিকাংশই ছিল বাঙালি এবং সবাই ছিল হিন্দু। মামলার সমগ্র পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলা যেতে পারে যে, এই ষড়যন্ত্রের সহযোগীরা বাংলার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের থেকে তাদের মূল অনুপ্রেরণা পেয়ে ধীরেধীরে বিপথগামী হয়ে পড়ে। রাসবিহারীর তত্ত্বাবধানে তারা একটি বিরাট বিপ্লবী চক্রের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গে পরিণত হয়। তারা এক নাজুক সময়ে দেশব্যাপী বিশাল রক্তপাত ঘটানোর দ্বারপ্রান্তে চলে আসে।
১২২. হরনাম সিংয়ের মামলা
বেনারস ষড়যন্ত্র সহ ঘাদির মহাচক্রান্তের ব্যর্থতার অল্প সময়ের মধ্যেই পাঞ্জাবের এক জাঠ শিখ হরনাম সিং, যিনি একসময় নবম ভূপাল পদাতিক বাহিনীর হাবিলদার ছিলেন এবং পরবর্তীকালে রেজিমেন্টাল বাজারের “চৌধুরি” ছিলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পরিকল্পনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আউধের ফাইজাবাদে গ্রেপ্তার হন। এটি প্রমাণিত হয় যে তিনি পাঞ্জাবের লুধিয়ানার সূচা সিং নামের এক ছাত্রের কাছ থেকে প্রাপ্ত বিপ্লবী পুস্তিকার মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদে প্রভাবিত হন। এই সূচা সিং ছিলেন রাসবিহারীর এক বার্তাবাহক। অনুসন্ধানে এটি প্রমাণিত হয় যে, পরবর্তিতে হরনাম সিং পাঞ্জাব সফর করেন এবং লিফলেট বিতরণ করেন; তিনি একটি বিপ্লবী পতাকা এবং ‘এলান-ই-জাঙ্গ’-এর একটি অনুলিপিও (ভারতের জনগণকে জেগে উঠার আহ্বান এবং দেশের সমস্ত ইউরোপীয়দের হয় হত্যা, না হয় তাড়িয়ে দেয়ার আহ্বান) তার কাছে পাওয়া যায়। বইটি তার বাড়িতে পাওয়া যায়। তবে তার অপারেশনগুলো সফল হয় নি। তার দোষ প্রমাণিত হয় এবং দশ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়।
১২৩. ‘যুগান্তর’ লিফলেট।
১৯১৬ সালের নভেম্বর মাসে বেনারস জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক দু'জন বাঙালি যুবককে শহরে প্রচলিত ধরনের ‘যুগান্তর’ লিফলেট ডাকযোগে প্রচার করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এদের মধ্যে নারায়ণচন্দ্র দে নামে এক ব্যক্তি, যার বয়স মাত্র চব্বিশ বছর হবে, ইতিমধ্যেই যুবকদের বিচ্ছিন্নতাবাদে দীক্ষিত করার কাজে সক্রিয় ছিলেন এবং বাংলার একটি ট্রেনে বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন। ওরিয়েন্টাল সেমিনারি নামে বেনারসের একটি স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করতেন। আর গ্রেফতার হওয়া আপরজন ছিলেন উনিশ বছর বয়সী এক যুবক, যিনি ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি থেকে মুদ্রা জাল করার অভিযোগে কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। ডাকযোগে চরমপন্থি প্রচারপত্র বিলির এই নিকৃষ্ট শখ চর্চার পাশাপাশি সে সুরিনাথ ভাদুরি নাম্নী বেনারসি এক বাঙ্গালির (যার অতীতও নানানরকম কুকীর্তিপূর্ণ) অধীনে কর্মী ছিল।
১২৪. অন্যান্য ঘটনা।
এই ঘটনাগুলোতে এটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এখন পর্যন্ত বিপ্লবী আন্দোলন, যুক্তপ্রদেশের সাধারণ জনগণের কোনো অংশকে প্রভাবিত করতে পারেনি, তবে বেনারস শহরটি, তার ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বিশেষ অবস্থানের কারণে সবসময়ই উদ্ভট সব ঝামেলার কেন্দ্রবিন্দু থাকবে। এই ঘটনাগুলো আরো প্রমাণ করে যে, বিচ্ছিন্নতাবাদের এই সংক্রামক ব্যাধি যখন ছড়াচ্ছিল, তখন তা খুব ধীরে এবং গোপনে চরমপন্থি লেখনী ও শিক্ষার মাধ্যমে যুবক শ্রেণির মাঝে ছড়িয়ে পড়ে, যারা চিন্তাগতভাবে অপরিপক্ব এবং যাদেরকে সহজেই প্রভাবিত করা সম্ভব; এই সংকীর্ণ পরিসরে এটি বছরের পর বছর ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিস্তৃতি লাভ করে এবং অবশেষে এমন একটি ষড়যন্ত্রে দানা বাধে যা একটি ভয়াবহ ট্র্যাজেডি সংঘটনের প্রায় দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছে। বেনারসের সাজাপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর থেকে যুগান্তরের বিচ্ছিন্নতাবাদী লিফলেট শহরের পাবলিক স্থানে লাগানো হয়েছে এবং সেখানে এর প্রতিক্রিয়ায় এসবের সাথে জড়িত সন্দেহে সন্দেহভাজন বাঙালিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যুক্তপ্রদেশের কলেজগুলোতে ভর্তি হওয়া ছাত্রদের নিয়ে এমন অন্তত তিনটি ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে যেখানে, ছাত্রদের সাথে বাংলার বিপ্লবীদের সাথে দেখা-সাক্ষাত হয়েছে, অথবা সাংকেতিক চিঠিপত্রে যোগাযোগ করতে দেখা গেছে। ১৯১৮ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি রাতে বেনারস ষড়যন্ত্র মামলায় পলাতক বিনায়ক রাও কপিলেকে লক্ষ্ণৌতে তার কয়েকজন সহ-বিপ্লবী গুলি করে হত্যা করেছে বলে ধারণা করা হয় এবং এটি সুনিশ্চিত যে তাকে একটি মাউসার পিস্তল দিয়ে গুলি করা হয়। পরবর্তী পুলিশি তদন্তের সময়, একজন বাঙালি সন্দেহভাজনকে একটি বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়, যেখানে দুটি ০.৪৫ বোরের রিভলবার এবং ২১৯ টি মাউসার পিস্তলের রাউন্ড পাওয়া গেছে, যেগুলো ‘রদ্দা অস্ত্র চোরাচালান’ ঘটনায় চুরি হওয়া। বোমা তৈরির ফর্মুলা এবং তামাক টিনকে বোমায় রূপান্তরের জন্য সংগ্রহ করা পিক্রিক অ্যাসিড এবং গান-কটন পাওয়া গেছে। এসব অভিযানের পর, স্থানীয় প্রশাসনকে ভয় দেখানোর জন্য প্রদেশগুলির বিভিন্ন শহরে সাধারণ যেসব উগ্রবাদী লিফলেট পাই আমরা, সেধরণের লিফলেট বিভিন্ন স্থানে পোস্ট করা হয়। এই পোস্টিংগুলি সম্ভবত ‘পোস্ট-বক্স’ যুবকদের কাজ ছিল।
দশম অধ্যায়: যুক্তপ্রদেশ এবং বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যে সংযোগ।
১২৫. ১৯০৭-০৮ এর নাগপুর
১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে গৃহীত দুটি প্রস্তাবের ফলে মধ্যপন্থী এবং চরমপন্থীদের মধ্যকার দূরত্ব কিছুটা লাঘব হয়। এর মধ্যে প্রথমটি ছিল, “দেশ পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়াদিতে যেহেতু জনগণের মতামত প্রদানের সুযোগ খুবই সীমিত অথবা একেবারেই নেই (সরকারের কাছে তাদের প্রতিনিধিত্ব যথাযথ বিবেচনা পায় না), সেহেতু এই কংগ্রেস মনে করে যে, বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে বাংলায় যে বয়কট (স্বদেশী) আন্দোলন শুরু হয়েছে তা বৈধ এবং কখনও অবৈধ ছিল না।”
দ্বিতীয়টি নিম্নরূপ, “স্বায়ত্ত্বশাসিত ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিতে যেরূপ সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান, এই কংগ্রেস মনে করে যে, সেরূপ শাসনব্যবস্থা ভারতেও সম্প্রসারিত করা উচিত; এবং তা অর্জনের পদক্ষেপ হিসাবে, (এই কংগ্রেস) নিম্নলিখিত সংস্কারগুলি অবিলম্বে সম্পাদন করার আহ্বান জানাচ্ছে।”
প্রস্তাবিত সংস্কারগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছিল। এই অধিবেশনের কার্যক্রম শেষে ঘোষণা করা হয় যে, ১৯০৭ সালের কংগ্রেস, যুক্তপ্রদেশের রাজধানী নাগপুরে অনুষ্ঠিত হবে, যা একসময় মারাঠা রাজ্যের আসন ছিল।
পুরো ১৯০৭ সাল জুড়ে নাগপুরের মধ্যপন্থী ও চরমপন্থীদের মাঝে ক্রমাগত দ্বন্দ্ব লেগে ছিল। স্থানীয় চরমপন্থী সংবাদপত্রের লেখার ভাব দিনকে দিন সরকারের প্রতি আরও বেশি বৈরী হয়ে উঠতে থাকে এবং স্কুলছাত্র ও শিক্ষার্থীদের উপর এর প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে। পুনা থেকে প্রকাশিত তিলকের ‘মারাঠি কেশরী’ পত্রিকা যেধরণের লেখালেখি-মতামত প্রকাশ করত, তা হিন্দিভাষী মানুষের পাশাপাশি মারাঠাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ১মে ‘হিন্দি কেশরী’ নামে একটি নতুন জার্নাল প্রকাশিত হয়। প্রচলনের প্রথম নয় মাসে, ‘হিন্দি কেশরি’র সার্কুলেশন সাপ্তাহিক ৩,০০০ কপিতে পৌঁছেছিল এবং এর নিবন্ধগুলি এতটাই ক্ষতিকারক হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল যে সামরিক কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনীতে এই পত্রিকার সার্কুলেশন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। একই চরিত্রের আরেকটি বিশিষ্ট পত্রিকা ছিল ‘দেশ সেবক’, যার উল্লেখ পরে আসছে।
কিন্তু নাগপুর চরমপন্থীদের এসব কৌশলের তীব্র বিরোধিতা করেছিল মধ্যপন্থীরা, এবং এই বিতর্ক এতটাই তীব্র ছিল যে নাগপুরের পরিবর্তে বোম্বে প্রেসিডেন্সির সুরাটকে কংগ্রেসের ডিসেম্বর অধিবেশনের স্থান হিসাবে নির্বাচিত করা হয়। চরমপন্থী প্রচারাভিযানের ফলে নাগপুর শহরটি কতটা গুরুতরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল তা প্রধান কমিশনার কর্তৃক ইন্সপেক্টর-জেনারেলকে লেখা একটি চিঠির নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদগুলি থেকে স্পষ্ট। ১৯০৭ সালের ২২শে অক্টোবর তারিখের চিঠি:—
মিস্টার ক্র্যাডক লেখেন, “নাগপুরে পুলিশ যেভাবে ছাত্রদের সঙ্গে আচরণ করছে তাতে আমি সন্তুষ্ট নই। পরিস্থিতি যেভাবে চলছে, যদি সেভাবেই চলতে থাকে, তাহলে আমাদের সকল বিশিষ্ট ব্যক্তিরা নাগপুর থেকে দূরে সরে যাবে। ভবিষ্যতের জন্য আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে উচ্ছৃঙ্খলতা কমিয়ে আনা হবে... আমি কমিশনারকে বলেছি আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বিষয়টি আলোচনার জন্য প্রিন্সিপাল এবং হেড মাস্টারদের একটি বৈঠক করতে, তবে তাদের সাথে বৈঠকের আগে পুলিশকে অবশ্যই উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রদের আটক করতে হবে। ক্রমাগত এই ধরনের ঘটনা ঘটার কারণে নাগপুর নিয়ে গণমাধ্যমে নেতিবাচক লেখালেখি হচ্ছে, এবং এগুলো বন্ধ করা উচিত... এখনই মোক্ষম সময় নাগপুরকে বিচ্ছিন্নতাবাদ উস্কানি দাতাদের প্রভাবে আবিষ্ট ছাত্রদের দুষ্ট-গরুর গোয়াল হওয়া থেকে রক্ষা করার।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল, কিন্তু বাংলার কুখ্যাত অরবিন্দ ঘোষের সফরের ফলে পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব হয়নি, যিনি ২২শে ডিসেম্বর সুরাট কংগ্রেসে যাওয়ার পথে নাগপুর এসেছিলেন। তিনি বয়কট এবং স্বদেশী আন্দোলনের সমর্থনে বক্তৃতা দেন। কংগ্রেস শেষে বাড়ি ফেরার পথে তিনি আবার নাগপুরে থামেন এবং একই বিষয়ে আবার বক্তৃতা দেন। তিনি সুরাটে তিলক এবং চরমপন্থীদের আচরণ এবং নীতির ন্যায্যতা প্রমাণ করেন। তিনি বলেন, বাঙালি ও মারাঠারা একই পিতা-মাতার সন্তান এবং তাদের একে অপরের দুঃখ ও আনন্দ ভাগাভাগি করা উচিত। স্বদেশী এবং বয়কট বাংলার মতো কোথাও বিকশিত হয়নি। ভারতের অন্য কেউ তার দেশের জন্য পরবর্তীকালের বাঙালিদের মতো এত সাহসিকতার সাথে কষ্টের ঘানি বহন করে নি, উদাহরণস্বরূপ যুগান্তরের সম্পাদক।
এরূপ প্রভাবের ফলে নাগপুরের চরমপন্থী সংবাদমাধ্যমে সরকারের প্রতি বিদ্বেষের সুর তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। মুজাফ্ফরপুর বোমা হামলার রেশ কাটতে না কাটতেই ১৯০৮ সালের ১১ই মে ‘দেশ সেবক’ পত্রিকায় নিম্নলিখিত ‘অসাধারণ’ অনুচ্ছেদগুলো ছাপা হয়। এতে বলা হয়, “ইংরেজদের সংস্পর্শে ভারতীয় জাতির মধ্যে যে সব লজ্জাজনক দোষ সঞ্চারিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল বোমা তৈরির অজ্ঞতা। সত্যি বলতে গেলে, প্রতিটি সচেতন নাগরিকের ‘অস্ত্রের ব্যবহার, বোমা প্রস্তুত করা ইত্যাদি’ সম্পর্কে ভাল জ্ঞান থাকা উচিত।” এতে আরও বলা হয়, “ইংরেজদের সংস্পর্শ ভারতের অবস্থাকে এতটাই করুণ করে তুলেছে যে, লোকেরা সবচেয়ে সাধারণ তুচ্ছ কাজ দেখে বিস্মিত হয়। তরুণ কিছু বাঙালি বোমাবাজি করে দু-তিনজনকে হত্যা করার খবর শুনে সিমলা থেকে সিলন পর্যন্ত পুরো জনপদ বিস্ময়ে আপ্লুত হয়। কিন্তু বোমা বানানো এত সহজ ব্যাপার যে, এতে কারো অবাক হওয়ার মত কিছু নেই। অস্ত্র ব্যবহার করা বা বোমা বানানো মানুষের স্বাভাবিক অধিকার। যদি মানব আইন এটি নিষিদ্ধ করে তবে এটি আমাদের পক্ষে এই আইন মান্য করা উচিত, তবে তার মানে এটি নয় যে ‘বোমা’ শব্দটি শুনলে আমাদের বিস্ময়ে আপ্লুত হতে হবে… এই বোমাগুলো কলকাতায় তৈরি হওয়ার খবর যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। অবশ্যই এটি উত্তম যে কেউ কোন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবে না, কিন্তু ব্যক্তিকে যদি নাশকতামূলক কাজ করার জন্য দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেয়া হয়, তবে তারা তেমনটিই করা উচিত যা প্রত্যেক বিবেকবান মানুষ করবে। প্রতারণার মাধ্যমে অলঙ্কার লুট করা, দলিল জাল করা, মিথ্যা শপথ গ্রহণ করা বা রাতে মানুষের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া কাপুরুষোচিত কাজ। আমরা মনে করি মিস্টার কিংসফোর্ডের জীবন কেড়ে নেওয়ার প্রয়াসে ক্ষুদিরাম বসুর পদক্ষেপ খুবই অযৌক্তিক, অবশ্যই। এবং কারওই তাঁর উদাহরণ অনুসরণ করা উচিত নয়। সুতরাং আমরা এধরনের অপরাধ এবং এই উদ্দেশ্যে কলকাতায় বোমা তৈরির বিরুদ্ধে আমাদের জোরালো প্রতিবাদ জানাই। এটা ঠিক যে কিভাবে বোমা বানাতে হয় তা আমাদের জানা উচিত, কিন্তু আমাদের অবশ্যই সরকারের কাছে এই অধিকার চাইতে হবে এবং এই অধিকার আদায় করে নিতে হবে। আইন ভঙ্গ করে বোমা তৈরি করা ঘৃণ্য কাজ। সরকারি আমলাদের হত্যা করা জাতিকে পুনরুজ্জীবিত করার উপায় নয় এবং জাতিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের মুণ্ডুপাত করার প্রয়োজন নেই। সম্পূর্ণ এবং নিঃশর্ত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এটি অপরিহার্য নয়, যা আমাদের জাতির চূড়ান্ত লক্ষ্য। এটি মাথায় না রাখায় আমরা আমাদের বাঙালি ভাইদের প্রতি ক্ষুব্ধ। ক্ষুদিরাম বসুর নিশানা থেকে পালাতে পারায় আমাদের অবশ্যই মিস্টার কিংসফোর্ডকে অভিনন্দন জানানো উচিত। এবং এটিও না বললেই নয় যে, কলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে মিস্টার কিংসফোর্ডের কাজগুলি ছিল জঘন্য এবং শয়তানিমূলক।” (মিস্টার কিংসফোর্ড রাষ্ট্রদ্রোহী সংবাদপত্রের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের বিচার করেছিলেন এবং দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। ‘বন্দে মাতরম’ প্রেসে পুলিশি তল্লাশিতে বাধা দেয়ার দায়ে তিনি সুশীল নামে এক বালককে পনেরোটি বেত্রাঘাতের দণ্ড দিয়েছিলেন।)
১৯০৮ সালের ১৬ই মে ‘হিন্দি কেশরী’ পর্যবেক্ষণ করে যে, যুগান্তরের বর্তমান সম্পাদকের বিচার চলছে এবং মানিকতলায় ব্যপক ধরপাকড় সত্ত্বেও ‘যুগান্তর’ এখনও প্রকাশিত হচ্ছে। (বেনারস) বোমা হামলার ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে ‘যুগান্তর’ বলেছে, এটা স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা। ইংরেজরা ভারতের রাজা নয়। ডাকাত, চোর ও দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে ষড়যন্ত্র বলা যায় না।
কিন্তু এমন বিস্ফোরক বক্তব্য, মানিকতলা মামলার বিচার (মামলার অভিযুক্তদের মধ্যে নাগপুর কলেজের এক ছাত্রও ছিলেন), তিলককে গ্রেফতার করা ইত্যাদি সত্ত্বেও, স্থানীয় সরকারের দৃঢ় মনোভাবের ফলে, মানুষের প্রতিক্রিয়া ছিল শীতল। ১৮ই জুলাই তিলকের জন্মদিনে যে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা নীরবে শেষ হয় এবং মুহাম্মদিরা তা এড়িয়ে যায়, যদিও মিস্টার হায়দার রাজা নামে একজন (মুসলমান) দিল্লি থেকে এসে তিলককে রাজনৈতিক গুরু বা সমগ্র ভারতের শিক্ষক হিসাবে আখ্যা দেন। মামলায় তিলককে দোষী সাব্যস্ত করার পরে দাঙ্গা শুরু করার চেষ্টা করা হয়েছিল; কিন্তু এগুলো দ্রুততার সাথে দমন করা হয় এবং তিলকের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের জন্য ডাকা একটি সভা নিষিদ্ধ করা হয়। প্রায় অর্ধ ডজন লোককে দাঙ্গার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়; বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংবাদপত্রের সম্পাদকদের বিচার করা হয়েছিল এবং শাস্তি দেয়া হয়েছিল; এবং স্থানীয় সরকার কর্তৃক জনসাধারণের শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে এমন কর্মকাণ্ড থেকে নিরত রাখার জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদে উস্কানিদাতা বক্তাদের ফৌজদারি কার্যবিধির অধীনে নিরাপত্তা হেফাজতে আনার নির্দেশ জারি করা হয়েছিল। ১৯০৮ সালের শেষের মাসগুলিতে দেশদ্রোহী কার্যকলাপের দৌরাত্ম সীমাবদ্ধ ছিল রানী ভিক্টোরিয়ার একটি মূর্তিতে কালি লেপন এবং ক্ষতবিক্ষত করার মধ্যে। ২৬শে নভেম্বর বিভিন্ন এলাকায় ‘সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ড’কে একজন শীর্ষস্থানীয় চরমপন্থী রাজনীতিবিদ পুলিশের ইন্সপেক্টর-জেনারেলের সাথে কথোপকথনের সময় এসবকে কেবল ‘ব্যক্তিগত ভুল আবেগের বহিঃপ্রকাশ’ বলে অভিহিত করেন। তার মতে একমাত্র ‘যুগান্তর’ই এরকম পত্রিকা, “যাতে প্রভাবিত হয়ে এধরনের ভুল ব্যক্তিগত আবেগ বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে।” প্রকৃতপক্ষে, আন্দোলন তার শক্তি ক্ষয় করে ফেলেছিল, এবং যে পরিস্থিতি একসময় বিপ্লবে রূপ নিবে বলে মনে হচ্ছিল, তা সম্পূর্ণরূপে অবদমিত হয়।
১২৬. ১৯১৫ সালের ঘটনা।
আমরা যতদূর জানি, ১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত যুক্তপ্রদেশে নতুন করে কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হতে দেখা যায় নি। ১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘাদির পার্টির পক্ষে রাসবিহারী কর্তৃক নলিনী মোহন মুখার্জিকে (বেনারস ষড়যন্ত্রের অন্যতম কুশীলব) জবলপুরের সৈন্যদের মাঝে ঘাদির পার্টির পরিকল্পনার অধীনে বিদ্রোহে যোগ দিতে প্ররোচিত করার জন্য নিযুক্ত করা হয়। এর আগ পর্যন্ত মধ্যপ্রদেশগুলো পুনরায় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সংস্পর্শে আসেনি। নলিনী সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হন এবং পরে বেনারস ষড়যন্ত্র মামলায় বিচারের সমমুখী হন এবং দোষী সাব্যস্ত হন। পরবর্তীকালে ‘ঢাকা অনুশীলন সমিতি’র নালিনী কান্ত ঘোষ, যিনি বাংলায় সংঘটিত বিভিন্ন আন্দোলনের সাথে যুক্ত এবং সম্প্রতি আসামের গোহাটিতে নাটকীয় ভাবে গ্রেপ্তার হয়েছেন, তিনি মধ্যপ্রদেশগুলি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন বলে জানা গেছে; এবং ১৯১৫ সালের শেষের দিকে বেনারসের একজন পলাতক ষড়যন্ত্রকারী, বিনায়ক রাও কপিলে তার সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং তার জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার জন্য জবলপুরে বসেছিলেন। তিনি সাত জনের একটি দল গঠন করেছিলেন, যথা, দু'জন ছাত্র, একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের দু'জন মাস্টার, একজন আইনজীবী, একজন ক্লার্ক এবং একজন দর্জি। আমরা যে দর্জি এবং এক ছাত্রের খোঁজ পেয়েছি তারা নিছক বার্তাবাহক হিসাবে কাজ করত। তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হলেও পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। বাকি পাঁচজনকে কারান্তরীণ করা হয়। এর ফলে বিনায়কের সংগঠনটি অঙ্কুরেই উৎপাটিত হয়। তিনি নিজেই প্রদেশ থেকে নিখোঁজ হন এবং পরবর্তীতে খুন হয়। (দেখুন অনুচ্ছেদ ১২৪)
এই ঘটনাটি একটি জাজ্বল্যমান উদাহরণ যে, যেখানে প্রদেশের সাধারণ মানুষের মাঝে কোন অসন্তোষ না থাকার পরও, সেখানে কিভাবে একজন বহিরাগত বিপ্লবী প্রদেশের জনগণের মাঝে অসন্তোষের বীজ বপন করেন। এবং সময়মতো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে কীভাবে দুষ্কৃতিকে গ্রেপ্তার করা যায় তারও একটি সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত এই ঘটনা।
Comments
Post a Comment