Skip to main content

বিচ্ছিন্নতাবাদ তদন্ত কমিটি রিপোর্ট, ১৯১৮, অধ্যায় ১৪, ১৫।

বিচ্ছিন্নতাবাদ তদন্ত কমিটি রিপোর্ট ১৯১৮ অধ্যায় ১৪, ১৫

সূচিপত্র

চতুর্দশ অধ্যায়: মুহাম্মাদীদের একটি বিদ্রোহ।

১৬০. ভারতীয় মুহাম্মাদীরা এবং যুদ্ধ।

১৬১. হিন্দুস্তানী ধর্মান্ধরা।

১৬২. লাহোরের ছাত্রদের পলায়ন।

১৬৩. এর তাৎপর্য।

১৬৪. “রেশমি রুমাল” ষড়যন্ত্রকারীরা।

১৬৫. উপসংহার।

পঞ্চদশ অধ্যায়: উপসংহারের সারসংক্ষেপ।

১৬৬. এই সমস্ত ষড়যন্ত্রের প্রকৃতি। তাদের ব্যর্থতা।

চতুর্দশ অধ্যায়: মুহাম্মাদীদের একটি বিদ্রোহ।

১৬০. ভারতীয় মুহাম্মাদীরা এবং যুদ্ধ।

১৯১১ সালের আদমশুমারির পরিসংখ্যান দেখায় যে ভারতে গড়ে প্রতি দশ জনের মধ্যে সাতজন হিন্দু, দু'জন মুহাম্মাদী এবং একজন অন্য ধর্মের অনুসারী। তবে মুহাম্মাদীরা সারা ভারতজুড়ে অসমভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে এবং বেলুচিস্তানে প্রতি দশজনের মধ্যে নয়জন, পাঞ্জাব ও বাংলায় প্রতি দুইজনে একজন, বোম্বেতে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন এবং যুক্তপ্রদেশে প্রতি সাতজনের মধ্যে একজন মুহাম্মাদী। ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম সার্বভৌমত্বের ক্ষয়িষ্ণু সময়ের হাত ধরে। এবং ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক গুরুত্ব সর্বদাই জনসংখ্যায় তাদের অনুপাত থেকে বেশি ছিল। কিন্তু নিয়তির অলঙ্ঘনীয় ঘটনাচক্রে যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা নিপতিত হয়, তার প্রাথমিক বছরগুলোতে, তারা পাশ্চাত্য শিক্ষার সুবিধাগুলো অনুধাবন করার ব্যাপারে ধীর ছিল; এবং অবশেষে যখন তাদের এই উপলব্ধি হল যে পশ্চিমা প্রশাসনের অধীনে কার্যকরভাবে এই শিক্ষাব্যবস্থাই প্রশাসন এবং ক্ষমতায় অংশগ্রহণের পথ হবে, ততদিনে তারা মাঠের দখল যথেষ্ট পরিমাণে হারিয়ে ফেলেছে। তবে তারা এই মাঠের বেশিরভাগ অংশ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়; এবং ১৯০৮ সাল যখন ‘মর্লি-মিন্টো সংস্কার’ কার্যকর হয়, তখন প্রতিনিধিত্বশীল মুহাম্মাদীরা ভারতীয় সাম্রাজ্যের কাউন্সিলগুলোতে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেন।

আমাদের পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোতে বর্ণিত ষড়যন্ত্রগুলোতে খুব কম মুসলমানই কোনও মাত্রায় জড়িত ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনকে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে ধ্বংস করার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে একমাত্র আন্দোলন যাতে মুহাম্মাদীরা জড়িত ছিল, বলা যেতে পারে তা একটি বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা, দুর্বলভাবে সমর্থিত এবং এই চেষ্টার প্রধান কারণ হল বর্তমান সময়ের পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি।

বর্তমান বিশাল সংগ্রাম সূচনা হওয়ার আগ থেকেই তুরস্কের প্রতি ভারতীয় মুসলমানদের সহানুভূতি দৃশ্যমান ছিল বরং ক্রিমিয়ার যুদ্ধের আগে থেকেই এই অনুভূতি দৃশ্যমান ছিল। তদুপরি উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ভারতের সাথে বিশ্বের বৃহত্তর স্বার্থের সংযোগ হওয়ায় এই সহমর্মিতার অনুভূতি আরো শক্তিশালী হয়। আবার অনেকের মাঝে প্যান-ইসলামিক ধ্যানধারণার প্রভাবে এই অনুভূতিটি পাখা মেলে; যা আমরা পূর্বে পাঞ্জাব নিয়ে অধ্যায়ে, ইতালি এবং তুরস্কের মধ্যকার যুদ্ধ এবং বলকান যুদ্ধের ঘটনা আলোচনার সময় উল্লেখ করেছি। পারস্য নিয়ে রাশিয়ার সাথে ব্রিটিশদের চুক্তিটি (মুসলমানদের নিকট) খুবই অপছন্দনীয় ছিল। পূর্বে ব্রিটেন, তুরস্কের প্রতি যে জোরালো সমর্থন প্রদর্শন করতো, তার পরিবর্তে বলকান যুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের নিষ্ক্রিয়তা পূর্বের ভূমিকার বিপরীত ছিল। মুসলমানদের কেউ কেউ বলেন যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী নীতি পরিবর্তন না হলে, এশিয়া এবং ইউরোপে মুসলিমদের চিহ্ন স্থায়ীভাবে বিলুপ্ত হবে। এর সাথে যোগ হয়েছিল কিছু মুসলিম পত্রপত্রিকার লেখনী, যেখানে, ভারতের অভ্যন্তরে বা বাইরের সমস্ত ঘটনা নিয়ে, এই তত্ত্বের সমর্থনে, বিভিন্ন ঘটনার সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হত।

এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে যখন আমরা ১৯১৪ সালের নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করি, তখন এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আবেগী মুহাম্মাদীরা কিছুটা জটিল সিদ্ধান্তের সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়ায়। যুদ্ধঘোষণা এসেছে তুরস্ক থেকে। প্যান-ইসলামিজম যে এই ঘটনার পর কোনো প্রকৃতিতে মাথা চারা দিয়ে উঠবে না বা কোনো ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করবে না, তা খুব সম্ভবত দুরাশার চেয়ে কম কিছু না। সাধারণ ভারতীয় মুসলমানরা যে অবস্থান নিয়েছে সঙ্গতভাবেই তারা তাদের ভূমিকার জন্য কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। এবং তাদের এই অবস্থানের পিছনে তুরস্ক যুদ্ধে প্রবেশের খবর প্রচারিত হওয়ার পরপরই ব্রিটিশ প্রশাসন কর্তৃক প্রচারিত একটি ঘোষণার প্রভাবও রয়েছে। এই ঘোষণা প্রচারিত হয় যে, আরবের পবিত্র শহর এবং ইরাকের পবিত্র মাজারগুলোতে ব্রিটেন ও তার মিত্ররা হামলা চালাবে না, এবং যুদ্ধকালীন ভারতীয় হজ্ব যাত্রীদের বিনাবিঘ্নে গমনাগমন এই ঘোষণার ব্যাপারে ব্রিটিশদের স্বদিচ্ছার স্বীকৃতি বহন করে। এবং একইসময়ে ভারতের প্রধান মুসলিম শাসক হায়দারাবাদের প্রধান মহামান্য নিজাম কর্তৃক প্রকাশিত ‘আনুগত্যের ইশতেহার’টি, তাঁর সহধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ নমুনা স্থাপন করে।

কিন্তু ধর্মান্ধ মুহাম্মাদীদের ছোট এবং অস্পষ্টভাবে চিহ্নিত একটি গোষ্ঠীর মধ্যে ইংল্যান্ডের শত্রুদের সাথে যোগদান বা সহায়তা করার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, এবং ভারতে বর্তমান ব্রিটিশ শাসনের পরিবর্তে একটি নতুন ইসলামী সাম্রাজ্যের তৈরির আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। এই আকাঙ্ক্ষা পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের জন্ম দেয় যা আমরা এখন বর্ণনা করব।

১৬১. হিন্দুস্তানী ধর্মান্ধরা।

উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ওপারে স্বাধীন অঞ্চলে হিন্দুস্তানি ধর্মান্ধদের একটি ছোট জনবসতি রয়েছে, যারা মুজাহিদিন নামে পরিচিত। আউধের রায়বেরেলির বাসিন্দা এবং ভারতে ওয়াহাবি সম্প্রদায়ের একজন কট্টর ধর্মবেত্তা, সাইয়্যেদ আহমদ শাহ জনবসতিটি স্থাপন করেন। ওয়াহাবিরা সুন্নিদের চেয়েও কট্টরপন্থী একটি উপভাগ যারা, আঠারো শতকের আরব সংস্কারক আবদুল ওয়াহাবের মতবাদে বিশ্বাসী, যিনি কুরআনের আক্ষরিক ব্যাখ্যা প্রচার করেন এবং ধর্মের পবিত্র বানীর উপর চাপিয়ে দেয়া পৌরোহিত্য আচার, সংস্কার-অনুষ্ঠান এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রত্যাখ্যান করেন। সাইয়্যেদ আহমদ, যিনি ভাগ্যান্বেষী হিসাবে জীবন শুরু করেছিলেন, ওয়াহাবি মতবাদ গ্রহণ করেন। তিনি ১৮২২ সালে মক্কা সফর করেন, সেখান থেকে ভারতে ফিরে আসেন। তিনি গাঙ্গেয় সমভূমির বিভিন্ন স্থানে অনুসারী অর্জন করেন এবং ১৮২৪ সালে পেশোয়ার সীমান্তের পাহাড়ী গোত্রগুলোতে আবির্ভূত হন এবং তিনি পাঞ্জাবের শিখ রাজ্যের বিরুদ্ধে জিহাদ বা যুদ্ধের প্রচার করেন। তার অনুসারীদের সাথে একত্রে, তিনি একটি জনবসতি স্থাপন করেন, যা ছোট হলেও, সময়ের নানান উত্থানপতনের মাঝেও এখন পর্যন্ত টিকে আছে। এটিকে প্রায়শই এই দেশের সহ-ধর্মাবলম্বীদের কাছ থেকে লোকবল এবং তহবিল দ্বারা সহায়তা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকে এই দলটির রাজনৈতিক প্রবণতা সম্পর্কে অনুসন্ধান না করে, একে একটি বিশুদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মনে করে তাদের সমর্থন যুগিয়েছে। এর সদস্যরা ভারতকে মুসলমানদের দ্বারা শাসিত নয় এমন একটি দেশ হিসাবে বিবেচনা করে এবং তাই মুসলিম বসতি স্থাপনের জন্য অনুপযুক্ত, শত্রু দেশ (দার-উল-হারব) হিসেবে গণ্য করে। তারা সবসময় জিহাদের প্রচার করেছে। তারা সর্বদা ভারতে তাদের বন্ধু-সমর্থকদের একটি গোপন সংগঠনের সাথে যোগাযোগ রেখেছে এবং সমর্থন পেয়ে এসেছে। ১৮৫৭ সালের ঝামেলার সময় বেশ কিছু বিদ্রোহী তাদের সাথে যোগ দেয় এবং সমগ্র সীমান্তব্যাপী আক্রমণ হানার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। পরবর্তীতে, তারা বিভিন্ন সীমান্ত যুদ্ধে অংশ নেয়। তারা ১৯১৫ সালের ঘনায়মান ঘটনাচক্র নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল যা পরবর্তীতে রুস্তম এবং শাবকাদরের সশস্ত্র সংঘর্ষে রূপ লাভ করে। শাবকাদরের যুদ্ধের পরে তাদের প্রথাগত কালো পোশাক পরিহিত অবস্থায় ১২ জনকে মৃত অবস্থায় মাঠে পড়ে থাকতে দেখা যায়।

১৬২. লাহোরের ছাত্রদের পলায়ন।

পাঞ্জাব সম্পর্কিত অধ্যায়ে, আমরা উল্লেখ করেছি যে ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরের পনেরোজন ছাত্র তাদের কলেজ ছেড়ে মুজাহিদিনদের সাথে যোগ দেয়, পরবর্তীতে কাবুলে চলে যায়, যেখানে তাদের প্রথমে কঠোর ভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। তাদেরকে পরে মুক্তি দেওয়া হয় এবং নজরদারির অধীনে চলাচলের কিছু স্বাধীনতা দেওয়া হয়। এরমধ্যে দু'জন ভারতে ফিরে আসেন। তিনজনকে রাশিয়ানরা ধরে নিয়ে যায় এবং ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। তারা তাদের আচরণের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করে এবং শর্তসাপেক্ষে ক্ষমা পায়। পুরো পনেরো জনকে তাদের ভক্তরা মুহাজিরিন (যারা নবী মুহাম্মদের উদাহরণ অনুসরণ করে নিপীড়ন থেকে নিষ্কৃতি লাভের আশায় নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়) বলে অভিহিত করে। যারা ফিরে এসেছেন তাদের মধ্যে দুজনের বক্তব্য আমরা পড়েছি। তাদের মধ্যে একজন মুদ্রিত পুস্তিকা দেখে মুগ্ধ হন, যেখানে তুরস্কের সুলতান ঘোষণা করেছেন যে ব্রিটিশরা মক্কা ও মদিনা আক্রমণ করতে পারে এবং অসম্মান করতে পারে। সুতরাং ভারতীয় মুহাম্মাদীদের উঠে দাঁড়ানো উচিত এবং একটি ইসলামী দেশ প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হওয়া উচিত। অমুসলিমদের বিরুদ্ধে জিহাদে তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অন্য ছাত্রটি সুলতানের ঘোষণায় সমানভাবে আন্দোলিত হয়েছিল এবং একটি ইংরেজি সংবাদপত্রে একটি ছবি দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছিল যা সে ইসলামী অনুভূতির প্রতি অপ্রীতিকর বলে মনে করেছিল। দু'জনেই এই মিথ্যা ধারণাটি লালন করছিলেন যে ভারতে মুহাম্মাদী ধর্মকে অপমানিত এবং নিপীড়িত করা হয়েছে।

১৬৩. এর তাৎপর্য।

বর্তমানের মতো সময়গুলো দীর্ঘদিন চাপা পড়ে থাকা এবং ভুলে যাওয়া ক্ষতকে আবার তাজা করে দেয়। পঞ্চাশ বছর আগে এই দেশে সামান্য কিছু মুহাম্মাদী ছিল যারা শিক্ষা দিত যে, পরকালে মুক্তির উপায় হল ব্যক্তিগতভাবে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অথবা এই উদ্দেশ্যে মুজাহিদদের জন্য লোক নিয়োগ করা বা অর্থ প্রেরণের মাধ্যমে সাহায্য করা। লাহোর থেকে পনেরো জন ছাত্রের পলায়ন, একটি জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ যে, এরূপ শিক্ষা এখনও সামান্য কিছু মুহাম্মাদী লালন করে। এই বাস্তবতাটি অন্যান্য প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত। ১৯১৭ সালের জানুয়ারী মাসে জানা যায় যে, পূর্ব বাংলার রংপুর ও ঢাকা জেলা থেকে আটজনের একটি দল মুজাহিদদের সাথে যোগ দিয়েছে। ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে দু'জন বাঙালি মুহাম্মদীকে ৮,০০০ রূপি সহ গ্রেপ্তার করা হয়, যা তারা সীমান্তপ্রদেশে তাদের ধর্মান্ধ জনবসতিটিতে পৌঁছে দিচ্ছিল। এই দু'জন কিছু সময়ের জন্য নিজেরাই মুজাহিদিন ছিলেন এবং চাঁদা সংগ্রহের জন্য তাদের নিজ নিজ জেলায় প্রেরণ করা হয়েছিল। এই ধরনের ব্যক্তিদের জন্য মাঠ প্রস্তুত করা হয় এবং ব্রিটিশ নিপীড়নের মিথ্যা অভিযোগ দ্বারা তাদের কাজ সহজতর করা হয়। তাদের এমন এক ধরণের সাহায্যকারী রয়েছে যারা নতুন নয়, তবে বহু বছর ধরে তারা প্রশাসনের নজরদারিতে নেই। ১৮৬৪ থেকে ১৮৭২ সালের মধ্যে এই ধরনের সাহায্যকারীদের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ভাবে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছিল। ১৮৬৮ সালে কিছু ওয়াহাবি ষড়যন্ত্রকারীকে ‘তৃতীয় বেঙ্গল রাজবন্দী সঙ্ক্রান্ত আইন, ১৮১৮’-এর বিধানের অধীনে আটক করা হয়েছিল। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের প্রয়াত স্যার উইলিয়াম হান্টার (তৎকালে মিস্টার হান্টার নামে পরিচিত) প্রকাশিত “আওয়ার ইন্ডিয়ান মুসলমানস” (আমাদের ভারতের মুসলিমরা) নামক বইয়ের নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদগুলো এই বন্দিদের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে: “এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, এই আইনটি যদি এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে – যা ১৮৫৮ সালের বিদ্রোহ এবং পরবর্তী অনুসন্ধানগুলোতে প্রকাশিত হয় – আগে প্রয়োগ করা যেত তবে, ব্রিটিশ ভারত ১৮৬৩ সালের সীমান্ত যুদ্ধ থেকে রক্ষা পেত। আমরা যদি কয়েকটি সুনির্দিষ্ট গ্রেপ্তার করতে পারতাম, তাহলে আম্বেলা পাসে নিহত বা আহত আমাদের প্রায় এক হাজার সৈন্যকে রক্ষা করতে পারতাম, এবং সেই যুদ্ধে খরচ হওয়া কয়েক লক্ষ পাউন্ড রক্ষা পেত। এমনকি যুদ্ধের পরও, ১৮৬৪ সালের রাষ্ট্রীয় বিচারের সময় যখন ষড়যন্ত্রটি প্রকাশ্যে চলে আসে, তখনই যদি শাসন বিভাগের গ্রেপ্তারের ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে শক্ত হাতে ধরপাকড় করে ষড়যন্ত্রটি গুড়িয়ে দেয়া যেত, তাহলে প্রায় সকল সম্ভাবনায় আমাদেরকে ১৮৬৮ সালে ব্ল্যাক মাউন্টেনে অভিযানটি পরিচালনার প্রয়োজন হত না…। সীমান্ত এলাকায় আমাদের ব্যয়বহুল যুদ্ধগুলো এবং আমাদের উপনিবেশের কঠোর বিচারিক শাস্তিও, এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীটিকে দমন করতে ব্যর্থ হয়। অবশেষে ১৮৬৮ সালে সরকার বিদ্রোহীদের দমনের জন্য তার গ্রেপ্তারের ক্ষমতা কঠোরভাবে প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। নিরপরাধ ব্যক্তির ক্ষতি করার ঝুঁকি ছাড়াই এই কর্মটি সম্পন্ন করা যেতে পারে…। বিদ্রোহীদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের তালিকা বেশ কয়েক বছর ধরে কর্তৃপক্ষের হাতে ছিল…। রাষ্ট্রদ্রোহের সবচেয়ে উৎসাহী প্রচারকদের গ্রেপ্তার করা হয়। এরফলে তাদের অনুসারীদের তারা যেই স্বপ্নে বুঁদ করে রেখেছিল, সেই স্বপ্ন উবে যায়। এবং যারা এই রাষ্ট্রদ্রোহী গোষ্ঠীর আরও গোপন এবং চতুর কিন্তু ধনী অংশ, তাদের বিরুদ্ধে ধীরেধীরে সাক্ষ্য-প্রমাণের এক স্তূপ জমা হয়। গোষ্ঠীর এই অংশটি অর্থায়ন দেখভাল করত এবং যারা ১৮৬৪ সালের বিচারে সেনাবাহিনীর ঠিকাদারদের মতো, রাষ্ট্রদ্রোহের ঝুঁকি নিয়েই একটি লাভজনক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল।”

বাংলার সরকারের ১৮৬৯ সালের নথিভুক্ত মামলার কার্যবিবরণীতে আমরা দেখতে পাই যে, গ্রেফতার হওয়া বন্দীদের মাঝে যারা পূর্বেও গ্রেফতার হয়েছিল, এমন প্রত্যেক পুরানো বন্দীর বিরুদ্ধে, অভিযোগ এবং সাজার কারণগুলোর সারসংক্ষেপ রয়েছে। আমরা একটি নমুনা উদ্ধৃত করি। এই উদ্ধৃতিটি মালদা জেলার নাজির সরদার নাম্নী এক ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত এবং এমন কিছু অভ্যাস প্রকাশ করে যা এখন বিরল তবে একেবারে বিলুপ্ত নয়। ১৮৬৮ সালের ১০ই নভেম্বর এই ব্যক্তির বিরুদ্ধেকে আটকের পরোয়ানা জারি করা হয়। এই পরোয়ানা জারির কারণ ছিল নিম্নরূপ: “দেখা গিয়েছে যে মালদার কালিয়াচক সংলগ্ন বেশ ক'টি গ্রামে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ বা ধর্মীয় যুদ্ধের জন্য প্রকাশ্যে অনুদান দেওয়া হয়ে, যার উদ্দেশ্য ছিল মুহাম্মাদী শাসন পুনরুদ্ধার করা এবং কাফিরদের (ইংরেজ) দেশ থেকে বিতাড়িত করা; বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ম্যাজিস্ট্রেট সাক্ষীদের সাক্ষ্য পরীক্ষা করেন। সাক্ষ্যের তথ্য থেকে জানা যায় যে, নাজির সিরদার এই আন্দোলনের নেতা ছিলেন; এবং তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে এই আন্দোলনে একটি সক্রিয় এবং বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন; এবং তিনি মালকা ও সিত্তানায় বেশ কয়েকজন লোককে হিন্দুস্তানীদের সাথে জিহাদে যোগ দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করেন; এবং তিনি এবং তার প্রতিনিধিরা জিহাদের উদ্দেশ্যে ওই এলাকার সমস্ত মুসলমানের কাছ থেকে অনুদান আদায় করেন। সাক্ষীদের সাক্ষ্যে আরও প্রমাণিত হয়েছে যে, ইব্রাহিম মণ্ডলই ছিলেন প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যক্তি, যার কাছে নাজির সর্দার, তাঁর এবং তাঁর প্রতিনিধিদের দ্বারা সংগৃহীত, সমস্ত অর্থ প্রেরণ করেন এবং ইব্রাহিম মণ্ডল প্রকাশ্যেই সেই অনুদানগুলো, সীমান্তজুড়ে ধর্মান্ধদের কাছে প্রেরণ করার ব্যাপারে দায়িত্ব নিয়ে ছিলেন।”

১৬৪. “রেশমি রুমাল” ষড়যন্ত্রকারীরা।

মুজাহিদদের সহমর্মী ব্যক্তিরা সংখ্যায় খুব কম, কিন্তু যোগাযোগের ধারায় একটি অপরিহার্য সংযোগ রক্ষা করে, যাদেরকে আমরা এখানে পরিচয় করিয়ে দিবো, যেই ব্যক্তিরা ভারতের মুসলমানদের সাথে প্রতিষ্ঠা হতে চেয়েছিলেন। ১৯১৬ সালের আগস্টে সরকারের কাছে “রেশমি রুমাল ষড়যন্ত্র” হিসাবে পরিচিত প্লটটি আবিষ্কৃত হয়। এটি উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ভারতে এই প্রকল্পটি তৈরি করা হয়, এর পরিপূরক হিসেবে দেশব্যাপী মুহাম্মাদীদের একটি বিদ্রোহের পরিকল্পনাও করা হয়। দেশব্যাপী বিদ্রোহে প্ররোচিত করা এবং এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ১৯১৫ সালের আগস্টের প্রথম দিকে মৌলভী ওবাইদুল্লা নাম্নী এক ব্যক্তি তিন সঙ্গী আবদুল্লাহ, ফতেহ মুহাম্মদ এবং মুহাম্মদ আলীকে নিয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অতিক্রম করেন। ওবাইদুল্লা একজন ধর্মান্তরিত শিখ এবং যুক্তপ্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দের মুসলিম ধর্মীয় স্কুলে মৌলভি হিসাবে প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। সেখানে তিনি তার নিজস্ব জঙ্গী ও ব্রিটিশ বিরোধী চিন্তাধারায় কিছু ছাত্র এবং কর্মচারীকে আক্রান্ত করেন এবং প্রধান ব্যক্তি যাকে তিনি প্রভাবিত করেছিলেন তিনি ছিলেন মাওলানা মাহমুদ হাসান, যিনি দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রধান মৌলভী ছিলেন। ওবাইদুল্লা বিখ্যাত দেওবন্দ স্কুলে প্রশিক্ষিত মৌলভীদের প্রাতিষ্ঠানিক গ্রহণযোগ্যতা এবং কর্তৃত্বকে ব্যবহার করে ভারতজুড়ে একটি প্যান-ইসলামিক এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক এবং পরিচালনা পর্ষদ তার পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেয়, যারা তাকে এবং তার কিছু প্রধান সহযোগীকে বরখাস্ত করে। এমন প্রমাণও রয়েছে যে তিনি কিছু বিষয়ে ঝামেলায় পড়েছিলেন। তবে মাওলানা মাহমুদ হাসান প্রতিষ্ঠানে থেকে যান এবং তার কাছে ওবাইদুল্লার যাতায়াতও অব্যাহত রাখেন। মাওলানার বাড়িতে গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হত এবং জানা যায় যে সীমান্ত এলাকার লোকদের সেখানে আনাগোনা ছিল। ১৯১৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মুহাম্মাদ মিয়া নাম্নী একজন ও অন্যান্য সঙ্গীদের নিয়ে, মাহমুদ হাসান, ওবাইদুল্লার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ভারত ত্যাগ করেন, তবে উত্তরে নয়, আরবের হেজাজ অঞ্চলের দিকে রওয়ানা করেন।

রওনা হওয়ার আগে, ওবাইদুল্লা দিল্লিতে একটি স্কুল শুরু করেছিলেন এবং ভারতীয় মুহাম্মদীদের কাছে সশস্ত্র ধর্মান্ধতা প্রচারের জন্য দুটি বই প্রকাশ করেন এবং তাদেরকে জিহাদের সর্বোচ্চ কর্তব্য পালনে প্রভাবিত করেন। মাওলানা সহ এই ব্যক্তি এবং তার বন্ধুদের সাধারণ উদ্দেশ্য ছিল ভারতে একটি বিরাট মুসলিম আক্রমণের পথ প্রদর্শন করা এবং তা একই সাথে সাধারণ মুসলিমদের একটি বিদ্রোহ সংঘটিত হবে। আমরা দেখব কিভাবে প্রত্যেকে তার উদ্দেশ্য অর্জনের চেষ্টা করেছে।

ওবাইদুল্লা এবং তার বন্ধুরা প্রথমে সীমান্ত এলাকার সেই হিন্দুস্তানি ধর্মান্ধদের সাথে দেখা করেন এবং পরে কাবুলে চলে যান। সেখানে তিনি একটি তুর্কো-জার্মান মিশনের সদস্যদের সাথে দেখা করেন যাদের সাথে তিনি ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হন; এবং কিছু দিন পরে, তার দেওবন্দের বন্ধু মৌলভী মুহাম্মাদ মিয়া আনসারী তার সাথে যোগ দেন। এই ব্যক্তি মাওলানা মাহমুদ হাসানের সাথে আরবে গিয়েছিলেন। তিনি ১৯১৬ সালে হেজাজের তৎকালীন তুর্কি সামরিক গভর্নর গালিব পাশার হাত থেকে মাওলানা মাহমুদ হাসান কর্তৃক প্রাপ্ত জিহাদের ঘোষণাপত্রটি নিয়ে ফিরে আসেন। যাত্রাপথে মুহাম্মদ মিয়া “গালিবনামা” নামে পরিচিত এই দলিলের অনুলিপি গুলো ভারত এবং সীমান্তবর্তী উপজাতিদের মধ্যে বিতরণ করেন। ওবাইদুল্লা এবং তার সহ-ষড়যন্ত্রকারীরা ব্রিটিশ ক্ষমতা উৎখাত হওয়ার পরে ভারতের অস্থায়ী সরকারের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। (ওবাইদুল্লাকে ভালভাবে চিনতেন এমন একজন তাকে এভাবে বর্ণনা করেছেন: “তিনি পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য একজন অসাধারণ ব্যক্তি ছিলেন, যেমন মনে হতে পারে যে তিনি একটি বিশাল সাম্রাজ্যের শাসক, কিন্তু যখন সত্যিকারের কাজ করার দরকার হয়, তখন তিনি নিজ উদ্যোগে কিছু করার ব্যাপারে অলস এবং উদাসীন ছিলেন।”) মহেন্দ্র প্রতাপ নাম্নী একজনের রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা ছিল। এই লোকটি ভাল পরিবার এবং অদ্ভুত চরিত্রের একজন হিন্দু, যিনি ১৯১৪ সালের শেষের দিকে ইতালি, সুইজারল্যান্ড এবং ফ্রান্সভ্রমণের জন্য পাসপোর্ট পান। তিনি সরাসরি জেনেভায় গিয়েছিলেন, সেখানে কুখ্যাত হরদয়ালের সাথে দেখা করেন এবং হরদয়াল তাকে জার্মান কনসালের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপরে তিনি বার্লিনে চলে যান এবং সেখানে তাকে একটি বিশেষ মিশনে প্রেরণ করা হয়, স্পষ্টতই তার গুরুত্ব সম্পর্কে অতিরঞ্জিত ধারণা পেয়ে জার্মানরা প্রভাবিত হয়েছিল।

ওবাইদুল্লা নিজেও ভারতের মন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল এবং কৃষ্ণবর্মার বন্ধু এবং আমেরিকান ঘাদির পার্টির সদস্য বরকতউল্লাহ, যিনি কাবুল হয়ে বার্লিন ভ্রমণ করেছিলেন, তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল। তিনি ভূপাল রাজ্যের এক কর্মচারীর পুত্র, তিনি ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং জাপান ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি টোকিওতে হিন্দুস্তানির অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি “দ্য ইসলামিক ফ্রাটারনিটি” (ইসলামী ভ্রাতৃত্ব) নামে একটি তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, যা জাপানি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে দমন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে তাকে তার নিয়োগ থেকে বরখাস্ত করা হয় এবং এরপরে তিনি আমেরিকায় তার ঘাদির পার্টির বন্ধুদের সাথে যোগ দেন।

জার্মান মিশনের সদস্যরা তাদের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়ে ১৯১৬ সালের প্রথম দিকে আফগানিস্তান ত্যাগ করে; কিন্তু ভারতীয়রা থেকে যায় এবং ‘অস্থায়ী সরকার’-এর পক্ষ থেকে রাশিয়ান তুর্কিস্তানের গভর্নর এবং রাশিয়ার তৎকালীন জার উভয়কেই চিঠি প্রেরণ করা হয়, রাশিয়াকে গ্রেট ব্রিটেনের সাথে তার জোট ত্যাগ করতে এবং ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে উৎখাত করতে সহায়তা করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে। এগুলো মহেন্দ্র প্রতাপ দ্বারা স্বাক্ষরিত ছিল এবং পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের হাতে চলে আসে। জারকে লেখা চিঠিটি একটি সোনার প্লেটে ছিল, যার একটি ছবি আমাদের দেখানো হয়েছে।

তুর্কি সরকারের সাথে ‘অস্থায়ী সরকার’ একটি জোট গঠনের ও প্রস্তাব করে এবং এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য ওবাইদুল্লা তার পুরানো বন্ধু মাওলানা মাহমুদ হাসানকে একটি চিঠি লিখেন। এই চিঠি এবং মুহাম্মদ মিয়া আনসারির লেখা ৮ রমজান (৯ জুলাই ১৯১৬) তারিখের আরেকটি চিঠি একত্রে তিনি “শেখ আবদুর রহিম, হায়দ্রাবাদ, সিন্ধ” নাম্নী এক ব্যক্তিকে সম্বোধন করে একটি কভার নোটর দিয়ে চিঠিগুলো প্রেরণ করেন, এই ব্যক্তি ওই ঘটনার পর থেকে পলাতক। কভার নোটে শেখ আব্দুর রহিমকে অনুরোধ করা হয় যেন তিনি, কোনো নির্ভরযোগ্য হাজীর (পূন্যার্থী) মাধ্যমে সংযুক্ত পত্রগুলো মক্কায় মাহমুদ হাসানের কাছে পাঠান অথবা কোনো বিশ্বাসযোগ্য সংবাদবাহক না পাওয়া গেলে তিনি নিজেই যেন তা পৌঁছে দেন। মাহমুদ হাসানকে লেখা চিঠিগুলো আমরা নিজেরাই দেখেছি, যেগুলো ব্রিটিশদের হাতে এসেছে। এগুলো হলুদ রেশমের উপর সুন্দরভাবে এবং স্পষ্টভাবে লেখা হয়েছে। মুহাম্মাদ মিয়ার চিঠিতে জার্মান ও তুর্কি পূর্ববর্তী মিশনের উল্লেখ ছিল, পরবর্তী মিশনে জার্মানদের ফিরে যাওয়া এবং তুর্কিদের থেকে যাওয়ার ঘটনাটি উল্লেখ ছিল, (এই মিশন নিয়ে সেখানে মন্তব্য ছিল) “কিন্তু কাজ ছাড়া”, পলাতক ছাত্রদের বিষয়টি উল্লেখ করা ছিল, “গালিবনামা” প্রচারের বিষয়টি উল্লেখ করা ছিল, এছাড়া “অস্থায়ী সরকার” এবং “আল্লাহ্‌র সৈন্যবাহিনী” গঠনের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল ভারত থেকে সৈন্য সংগ্রহ করা এবং ইসলামী সরকারগুলোর মধ্যে একটি জোট তৈরি করা। মাহমুদ হাসান উসমানী সরকারকে এসমস্ত বিবরণ পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। ওবাইদুল্লার চিঠিতে “আল্লাহ্‌র সেনাবাহিনী” সম্পর্কে একটি সারণীবদ্ধ বিবৃতি ছিল। এর সদর দফতর হওয়ার কথা ছিল মদিনায় এবং মাহমুদ হাসান নিজেই সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হওয়ার কথা ছিল। কনস্টান্টিনোপল, তেহরান এবং কাবুলে স্থানীয় সেনাপ্রধানদের অধীনে শাখা সদর দফতর স্থাপনের কথা ছিল। কাবুলের সেনাপ্রধান হবেন ওবাইদুল্লা নিজেই। সেই সারণীতে তিনজন পৃষ্ঠপোষক, ১২ জন ফিল্ড মার্শাল এবং আরও অনেক উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার নাম রয়েছে। লাহোরের ছাত্রদের মধ্যে একজন মেজর-জেনারেল, একজন কর্নেল এবং ছয়জন লেফটেন্যান্ট-কর্নেল হওয়ার কথা ছিল। এই হাই কমান্ডগুলোর জন্য মনোনীত অধিকাংশ ব্যক্তির তাদের সাথে নিয়োগের বিষয়ে পরামর্শ করা হয়েছে বলে মনে হয় না। কিন্তু রেশমে লেখা চিঠিগুলোতে যে সমস্ত তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা কিছু সতর্কতা অবলম্বনকে অবধারিত করে দেয় এবং অদ্যবধি সেগুলো গ্রহণ করা হয়েছে।

১৯১৬ সালের ডিসেম্বরে মাওলানা মাহমুদ হাসান ও তার চার সঙ্গী ব্রিটিশদের হাতে আটক হন। তারা এখন ব্রিটিশদের আয়ত্তে ‘যুদ্ধবন্দী’ হিসেবে বন্দি আছেন। গালিব পাশা, যিনি “গালিবনামা”-র স্বাক্ষরকারী, তিনিও একজন যুদ্ধবন্দী এবং স্বীকারোক্তি দেন যে, মাহমুদ হাসান গং তার সামনে একটি কাগজ উপস্থিত করে যাতে তিনি স্বাক্ষর করেছেন। এর বিশেষ কিছু অনুচ্ছেদের অনুবাদ নিম্নরূপ: “এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার মুহাম্মাদীরা সব ধরণের অস্ত্র দিয়ে নিজেদের সজ্জিত করেছিল এবং আল্লাহর পথে জিহাদে যোগ দিতে ছুটে এসেছিল। সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ধন্যবাদ যে তুর্কি সেনাবাহিনী ও মুজাহিদিন ইসলামের শত্রুদের পরাজিত করেছে…। হে মুসলমানগণ, অতএব, আপনারা প্রজা নিপীড়ক খ্রীষ্টান সরকারকে আক্রমণ করুন, যার দাসত্বের অধীনে আছেন আপনারা...। দ্রুত অগ্রসর হউন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ভাবে নিজেদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে একত্র করে, শত্রুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করতে এবং তাদের প্রতি আপনার ঘৃণা ও শত্রুতা দেখানোর জন্য জন্য। আপনারা হয়তো এটাও জানেন যে, মৌলভী মাহমুদ হাসান আফেন্দি (পূর্বে ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় ছিলেন) আমাদের কাছে এসেছিলেন এবং আমাদের পরামর্শ চেয়েছিলেন। এ ব্যাপারে আমরা তার সঙ্গে একমত হয়েছি এবং তাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছি। যদি তিনি আপনাদের কাছে আসেন তবে আপনাদের জন্য উচিত হবে তাকে আস্থায় নেয়া এবং তাকে ধন-জন এবং তার আর যা প্রয়োজন তা দিয়ে তাকে সহায়তা করা।”

১৬৫. উপসংহার।

এই অধ্যায়ে বর্ণিত ঘটনাগুলো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে কিছু মুহাম্মাদী ধর্মান্ধ ভারতে প্রথমে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং তারপরে বিদ্রোহ উস্কে দেওয়ার জন্য উদ্বিগ্নতার সাথে দিনাতিপাত করছিল। তাদের লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে তারা ব্রিটেনের শত্রুদের সাথে সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক। তাদের যুদ্ধ চালানোর পদ্ধতিসমূহ গোপন ষড়যন্ত্র এবং প্রচার থেকে শুরু করে প্রকাশ্য বিদ্রোহ পর্যন্ত বিস্তৃত। কখনও কখনও তারা নতুন যোগ দেয়া সদস্যদের যুদ্ধের জন্য পাঠায় আবার কখনও অর্থ সংগ্রহ ও প্রেরণ করে। কখনও কখনও তারা নিজেরাই যায়। তারা সবসময় বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রচার করে। তাদের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সাধারণ মুসলিম সম্প্রদায়ের আনুগত্য এবং সরকারের কার্যকর ক্ষমতাই একমাত্র রক্ষাকবচ।

পঞ্চদশ অধ্যায়: উপসংহারের সারসংক্ষেপ।

১৬৬. এই সমস্ত ষড়যন্ত্রের প্রকৃতি। তাদের ব্যর্থতা।

আমরা এখন পর্যন্ত বিপ্লবী আন্দোলনের সাথে জড়িত সমস্ত ষড়যন্ত্র তদন্ত করেছি। বোম্বেতে তারা সম্পূর্ণরূপে ব্রাহ্মণ এবং বেশিরভাগই চিতপাবন ছিল। বাংলায় ষড়যন্ত্রকারীরা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যুবক। তাদের প্রচারণা বিস্তৃত, অবিরাম এবং সৃজনশীল। তাদের নিজ প্রদেশে এর ফলে হত্যা এবং ডাকাতির একটি দীর্ঘ ধারা তৈরি করেছে। বিহার এবং উড়িষ্যা, যুক্তপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং মাদ্রাজে বিচ্ছিন্নতাবাদ কোনও শিকড় গাঁড়তে পারে নি, তবে মাঝে মাঝে অপরাধ বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল। পাঞ্জাবে আমেরিকা ফেরত অভিবাসীদের প্রত্যাবর্তনের ফলে প্রদেশটি বিপ্লব ও রক্তপাতের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং অসংখ্য বিক্ষোভ সংঘটিত হয়। এবং ১৯১৫ সালের ঘাদির ষড়যন্ত্রের জন্ম নেয়। বার্মাতেও, ঘাদির আন্দোলন সক্রিয় ছিল, কিন্তু থামানো হয়েছিল।

অবশেষে আসে মুহাম্মাদীদের একটি ষড়যন্ত্র যা ধর্মান্ধদের একটি ছোট চক্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং বৈদেশিক সহায়তায় ব্রিটিশ শাসনকে উৎখাত করার পরিকল্পনা করেছিল।

এই সমস্ত ষড়যন্ত্র একই উদ্দেশ্যের দিকে পরিচালিত হয়েছে, তা হল শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করা। কখনও কখনও এসব ষড়যন্ত্র বিচ্ছিন্ন ছিল; কখনও কখনও ষড়যন্ত্রগুলো পরস্পর সংযুক্ত ছিল; কখনও কখনও তারা জার্মান প্রভাব দ্বারা উত্সাহিত এবং সমর্থিত হয়েছে। ভারতীয়দের আনুগত্যের সমর্থনে সবগুলো ষড়যন্ত্র সফলভাবে মোকাবেলা করা হয়েছে। কিন্তু এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, এত সতর্কতার সাথে পরিকল্পিত এবং খুঁজে পাওয়া কঠিন ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় সরকার অতিরিক্ত আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়েছে। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখাব যে, কেন তুলনামূলক কম টালমাটাল সময়ে প্রণীত আইন এবং কার্যপদ্ধতি উপরে বর্ণিত কিছু ষড়যন্ত্রের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির প্রয়োজন পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

Comments

Popular posts from this blog

নাসিরুদ্দিন আলবানী রহঃ রচিত ‘সিলসিলাতুল আহাদীসিয যয়ীফা’ অনূদিত বাংলা সংস্করণ – একটি পর্যালোচনা | মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

নাসিরুদ্দিন আলবানী রহঃ রচিত ‘সিলসিলাতুল আহাদীসিয যয়ীফা’ অনূদিত বাংলা সংস্করণ – একটি পর্যালোচনা মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল ...

ফিকহে হানাফীর সনদ - মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক দাঃবাঃ

ফিকহে হানাফীর সনদ - মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক দাঃবাঃ (মূল লেখাটি মাসিক আল কাউসারে চার কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল।) ভূমিকা: আল্লাহ তা'আলা কুরআনী শরীয়ত তথা ইসলামী শরীয়তের হিফাযতের দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেছেন। এই শরীয়ত হল সর্বশেষ শরীয়ত। আল্লাহ সে শরীয়তের হিফাযতের দায়িত্বই নিজে গ্রহণ করেছেন যা কিয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকা মহান আল্লাহর অভিপ্রায়। বিজ্ঞ লোকেরা জানেন যে, শুধু কুরআন-সুন্নাহই নয়, কুরআন-সুন্নাহকে বোঝা যে বিষয়গুলোর উপর নির্ভরশীল সেগুলোকেও আল্লাহ তা'আলা পূর্ণরূপে হিফাযত করেছেন। তদ্রূপ, কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা ও নির্দেশনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং তার বিন্যাস ও সংকলনের জন্য যে শাস্ত্রগুলোর সূচনা, সেগুলোকে ও সেগুলোর বুনিয়াদী গ্রন্থগুলোকেও আল্লাহ হিফাযত করেছেন। আজ শতশত বছর পরও ইলমে হাদীস, ইলমে তাফসীর, ইলমে ফিকহ ইত্যাদি শাস্ত্রের মৌলিক গ্রন্থগুলো আমাদের কাছে ঠিক সেভাবেই সংরক্ষিত আছে যেভাবে এ গ্রন্থগুলো রচিত ও সংকলিত হয়েছিল। কপিকার ও মুদ্রাকরের বেখেয়ালতে কোনো ভুল-ত্রুটি হয়ে গেলে তা চিহ্নিতকরণ ও সংশোধনের জন্যও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে, যার ভিত্তিতে ভুল-ত্রুটি চিহ্নিত ও সংশোধিত হওয়ার...